পার্সিমন। ইংরেজিতে Persimmon আর এর বৈজ্ঞানিক নাম Diospyros Kaki. এটি প্রধানত এশিয়া মহাদেশের ফল। জাপানে এর নাম Hoshigaki, চীনে Shibing, কোরিয়ায় Gotgam কিংবা Hangul এবং ভিয়েতনামে Hong kho নামে পরিচিত। ইসরাইলে এ ফলটিকে বলা হয় Sharon fruits. এটি সুস্বাদু , সুমিষ্ট, সুদৃশ্য এবং লোভনীয় একটি ফল। ফ্রিজে রেখে খেলে এর মিষ্টতা আরও বেড়ে যায়।
ফলটি দেখতে অবিকল আমাদের দেশের পাকা গাবের মতো। কোনটা আবার পাকা টমেটোর মতো হয়ে থাকে। অত্যন্ত সুস্বাদু ও সুমিষ্ট এ ফলটি পাকলে সবুজাভ হলুদ রঙ ধারণ করে। প্রজাতিভেদে হলুদ, কমলা, লাল, বাদামী এমনকি কালচে রঙের পার্সিমনও দেখা যায়।
পার্সিমন একটি চির সবুজ গাছ। প্রজাতিভেদে এ গাছের উচ্চতা ১৫ থেকে ৫০ ফুট পর্যন্ত হয়। আর ফলের ডায়ামিটার হয় ০.৫৯" থেকে ৩.৫৪" পর্যন্ত। পুরুষ ফুল এবং স্ত্রী ফুল আলাদা গাছে হয়। আবার কিছু প্রজাতির গাছ আছে যাতে একই সাথে পুরুষ ও স্ত্রীফুল ফোটে।
সমগ্র পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৩৬ লক্ষ মে.টন পার্সিমন উৎপাদিত হয় তন্মধ্যে চীন একাই করে ৫৫% বা ২০ লক্ষ মে.টন। এরপর দ.কোরিয়ায় ৩ লক্ষ মে.টন, জাপানে ২লক্ষ ৬০ হাজার মে.টন, ব্রাজিলে ১লক্ষ ২০ হাজার মে.টন পার্সিমন উৎপাদিত হয়। এছাড়া USA, ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চল, মিয়ানমার, ভারত, নেপাল, ইসরাইল, আজারবাইজান, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে পার্সিমন উৎপাদিত হয়।
সাধারণত পাকা ফলের পাতলা খোসা ছুরি দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে ভিতরের শাঁস স্লাইস করে সরাসরি খাওয়া হয়। কোনো কোনো দেশে রান্না করে বিভিন্ন ধরনের খাবার প্রস্তুত করেও খাওয়া হয়। এছাড়া পাকা কিংবা আধা পাকা ফল শুকিয়ে টিনজাত করে রাখা হয়। জাপানে এ গাছের পাতার রস জ্বাল দিয়ে চায়ের মতো পান করা হয়, যার নাম kaki no ha chu. এর ফল থেকে ভিনেগারও প্রস্তুত করা হয়।
পার্সিমন উচ্চ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ একটি ফল। প্রজাতিভেদে শর্করার পরিমাণ থাকে ১৯-৩৩%, হজমযোগ্য আঁশ থাকে ৪% এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ বিদ্যমান থাকায় এটি অনেক ধরনের রোগ প্রতিরোধ এবং নিরাময়ে সহায়তা করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য ও অর্শ রোগ প্রতিরোধে পার্সিমন ফল খাওয়া হয়। রান্না করা ফল ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগে ব্যবহার করা হয়। মাদকাসক্ত রোগীর চিকিৎসায় এফল ব্যবহার করা হয়। হুপিং কাশি রোগের প্রতিরোধে এবং সাপের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে এ ফল ব্যবহার করা হয়। ব্যাকটেরিয়াজনিত বিষাক্ততার বিরুদ্ধেও কার্যকর ভূমিকা রাখে।
সমগ্র পৃথিবীতে ৭৫০ প্রজাতির পার্সিমন উৎপাদিত হয়। অধিকাংশই বীজশূণ্য। তবে কিছু প্রজাতি রয়েছে যেগুলো বীজযুক্ত। কিছু প্রজাতির শাঁস আঁশ বিহীন আবার কিছু আছে আঁশযুক্ত। পার্সিমন গাছের শক্ত কাঠ দ্বারা জাপান, কোরিয়া ও চীনে বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র প্রস্তুত করা হয়। পার্সিমনের উন্নত জাতগুলো হলো- Diospyros kaki (জাপানিজ), Diospyros virginiana (আমেরিকান), Diospyros digyna (কালো রঙ- মেক্সিকান),
Diospyros peregrina( ইন্ডিয়ান) ইত্যাদি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মপ্লাজম সেন্টারে এ ফলের পরীক্ষামূলক উৎপাদন সফল হয়েছে। এছাড়া ব্যক্তি উদ্যোগে বড় বড় নার্সারি গুলোতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। তারা এখন এর চারাগাছ বিক্রি করছেন। যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে এ ফলের চাষ হয় সেজন্য আমদের দেশেও এ ফল উৎপাদনের উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে।
"পার্সিমন ফলের উপকারিতা ও পুষ্টিমান"
পার্সিমন ফলে রয়েছে অনেক পুষ্টিগুণ। প্রতি ১০০ গ্রাম তাজা পার্সিমন ফলে ২৯৩ কিলো জুল বা ৭০ ক্যালরি খাদ্য শক্তি পাওয়া যায়। এর হলুদ রঙের কোষ হচ্ছে ভিটামিন ‘এ’ সমদ্ধ। পার্সিমন আমাদের দেহের ভিটামিন ‘এ’ এর চাহিদা পূরণ করে। সেজন্য এই ফল অপুষ্টিজনিত সমস্যা, রাতকানা এবং রাতকানা থেকে অন্ধত্ব প্রতিরোধ করার জন্য খুবই উপযোগী ফল।
শিশু, কিশোর, কিশোরী এবং পূর্ণ বয়সী নারী-পুরুষ সব শ্রেণীর জন্যই পার্সিমন খুবই উপকারী ফল। গর্ভবতী এবং যে মা বুকের দুধ খাওয়ান তাদের জন্য পার্সিমন দরকারি ফল। শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব দেখা দিলে ত্বক খসখসে হয়ে যায় এবং শরীরের লাবণ্যতা হারিয়ে ফেলে। পার্সিমন এ ধরনের রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। এ ছাড়া পার্সিমনে প্রচুর পরিমাণে শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানব দেহের জন্য বিশেষ উপকারী।
১০০গ্রাম পার্সিমনে ০.৫৮ গ্রাম আমিষ ও ১৮.৫৯ গ্রাম শর্করা আছে। চিনির পরিমাণ ১২.৫৩ গ্রাম। পার্সিমনে চর্বির পরিমাণ নিতান্ত কম মাত্র ০.১৯ গ্রাম। এজন্য এই ফল খাওয়ার কারণে ওজন বৃদ্ধির আশংকা কম। পার্সিমন পটাশিয়ামের উৎকৃষ্ট উৎস। পটাশিয়াম উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এ জন্যে পার্সিমন খেলে উচ্চ রক্ত চাপের উপশম হয়।
পার্সিমন অন্যতম উপযোগিতা হল ভিটামিন 'সি'। প্রাকৃতিকভাবে মানবদেহে ভিটামিন “সি” তৈরি হয় না। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দাঁতের মাড়িকে শক্তিশালী করে ভিটামিন “সি”। পার্সিমনে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস- আলসার, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ এবং বার্ধক্য প্রতিরোধে সহায়তা করে।
পার্সিমনে প্রচুর পরিমাণে শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানব দেহের জন্য বিশেষ উপকারী। এতে আছে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা আমাদের দেহকে ক্ষতিকর ফ্রির্যাডিকেলস থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও আমাদেরকে সর্দি-কাশি রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
টেনশন এবং নার্ভাসনেস কমাতে পার্সিমন ভালো কাজ করে। এতে প্রচুর পরিমাণে শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানব দেহের জন্য বিশেষ কার্যকরী। পার্সিমনে থাকে খাদ্য আঁশ ৩.৬০ গ্রাম, এই ফল আঁশালো বিধায় কোষ্ঠকাঠিণ্য দূর করে। পার্সিমনে রয়েছে খনিজ উপাদান আয়রন যা দেহের রক্তাল্পতা দূর করে।
১০০ গ্রাম তাজা পার্সিমনে বিদ্যমান ভিটামিন সমূহ :
ভিটামিন-A তে রূপান্তরযোগ্য বিটা ক্যারোটিন 834 μg
থায়ামিন (B1) 0.03 mg
রিবোফ্লাভিন (B2) 0.02 mg
Niacin নায়াসিন (B3) 0.1 mg
ভিটামিন-B6 0.1 mg
ফলেট (B9) 8 μg
কোলিন 7.6 mg
ভিটামিন-C 7.5 mg
ভিটামিন-E 0.73 mg
ভিটামিন-K 2.6 μg
১০০ গ্রাম তাজা পার্সিমনে যে সকল খনিজ উপাদান রয়েছে তা হলো :
ক্যালসিয়াম 8 mg
লৌহ 0.15 mg
ম্যাগনেশিয়াম 9 mg
ম্যাঙ্গানিজ 0.355 mg
ফসফরাস 17 mg
পটাসিয়াম 161 mg
সোডিয়াম 1 mg
জিংক 0.11 mg
(সংগৃহিত
মো. আলী আশরাফ খান
মহাব্যবস্থাপক (অবসরপ্রাপ্ত), বিসিক।)
উত্তর সমূহ